মুনজের আহমদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্য থেকে
ব্রিটেনে বেকারত্ব গত পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ চ্যান্সেলর রিশি সুনাক শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বলেছেন, চলতি অর্থবছরে সরকার ২৭১ বিলিয়ন পাউন্ড ঋণ করেছে। সঙ্গত কারণেই ভালো নেই সেখানে থাকা বাংলাদেশিরাও। কমিউনিটির লক্ষাধিক মানুষ গত কয়েক মাস ধরেই বেকারত্বের মধ্যে আছেন। অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদেরকে।
কোভিড-১৯ বিধি-নিষেধ এবং লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কারি শিল্পে বেশি প্রভাব ফেলেছে। রেস্তোরাঁগুলোতে কর্মসংস্থানের মারাত্মক পতন ঘটেছে। রেস্তোরাঁ, আবাসিক হোটেল, এবং সুপার মার্কেটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যাদের কাজ চলে গেছে, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও তাদের কাজে ফেরাটা খুব সহজ হচ্ছে না।
মৌলভীবাজার ইউকে’র সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি মুহূর্ত বৃটেনের করোনা আতঙ্ক কাটানো মানুষগুলোর জন্য করোনামুক্ত সামনের দিনগুলোতে উপার্জন করে বেঁচে থাকাটা হবে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যের ধরন ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ব্যবসা না হওয়ার কারণে কর্মী ছাঁটাই করে অর্ধেক কর্মী দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে দুইজন কর্মীর মধ্যে একজনের কাজ চলে যাওয়াতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তেমন সমস্যা না হলেও চাকরিচ্যুত মানুষদের পরিবার ভোগান্তিতে পড়ছে। কারণ হয়তো চাকরি হারানো সেই মানুষটাই ছিলো তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।
ব্রিটেনে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে যুক্ত আছেন মিনিক্যাব ইন্ড্রাস্ট্রিতে। কয়েক লাখ বাংলাদেশি এই ক্যাব চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। করোনার আঘাতের প্রথম দিকে তাদের উপার্জন একদম শুন্যের কোটায় চলে গিয়েছিলো।
ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম খছরু বলেন, ‘ব্রিটেনে অভিবাসী বাংলাদেশিদের মুল পেশা ট্যা ক্সি চালনা, রেস্টুরেন্ট, হসপিটালিটি ও কেয়ারিং খাত। একমাত্র স্যোশাল কেয়ারিং ছাড়া সব খাতেই করোনায় ধস নেমেছে। এছাড়া সরকার যত ধরনের সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে সবই দেওয়া হচ্ছে পুর্বের ঘোষিত আয়ের উপর ভিত্তি করে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষজন ট্যাক্স এড়াতে ও সরকার ঘোষিত নিম্ন আয়ের সব সুযোগ সুবিধা পেতে আয়ের পুরোটা প্রদর্শন করতেন না। সে কারনে ফার্লো বা সেল্ফ এমপ্লয়েড গ্রান্টের সুবিধা তারা পুরোপুরি পাচ্ছেন না।’
বেডফোর্ডে বসবাসরত সাংবাদিক ও কমিউনিটি নেতা সায়েকুল হক সায়েক বলেন, ব্রিটেনে বাঙালির মুল ব্যিবসা এখনো রেস্তোরাঁ ব্যেবসা। দু দফায় প্রায় এক বছর ধরে ব্রিটেনের রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ। সীমিত পরিসরে টেইক ওয়ে চালু থাকলেও প্রতিটি রেস্তোরাঁয় কর্মী কমেছে অর্ধেকের বেশি।
ব্রিটেনে যাদের বসবাস বা কাজের বৈধ কাগজপত্র নেই এমন মানুষজনের সিংহভাগই কাজ করতেন রেস্তোরাঁয়, থাকতেন সেখানকার স্টাফরুমে। করোনায় সবচেয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মুলত অবৈধ অভিবাসীরাই। কোনও ধরনের করোনাকালীন সরকারি সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। কাজও পাচ্ছেন না।
লন্ডনে বসবাসরত সমাজকর্মী ও লেখক এডভোকেট বিপ্লব কুমার পোদ্দার বলেন, মানুষজনের হাতে নগদ অর্থ নেই। সঞ্চয় ভেঙ্গে অনেকে চলছেন। ব্রিটেনে বাইসাইকেল চুরি থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি, ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা অতীতের তুলনায় বেড়েছে কয়েকগুণ। ঠিক কয় লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন করোনায় সেটা বোঝা যাবে ফার্লো শেষ হবার পর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যাকলয়ের সাবেক ছাত্রনেতা যুক্তরাজ্যই প্রবাসী ফয়সল রহমান বলেন, কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন করোনায় নিজ দেশের জনগণের পাশে আছে। করোনায় এদেশে বড় বড় কোম্পানিগুলো ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা কর্মীদের ঘর থেকে কাজ করিয়ে দেখেছে তাদের কাজ চলছে। আগামীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কোম্পানিগুলো এ পথে ঝুঁকেছে। কম কর্মী দিয়ে কাজ করিয়ে সুপারস্টোরগুলো দেখছে ব্যবসা চলছে। আগামীতে এ ধারা চললে ব্রিটেনে কর্মসংস্থান কমবে।
উল্লেখ্য, দুই দফার করোনা ঢেউয়ে বিএমই (ব্ল্যাগক এন্ড মাইনোরিটি এথনিক) কমিউনিটির মধ্যে বাংলাদেশিদের মৃত্যুাহার এখনো শীর্ষ তালিকায়। করোনায় এখন পর্যন্ত ব্রিটেনে প্রায় চারশজন বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। বেকারত্ব, কর্মহীনতার হতাশা আর গৃহবন্দিত্বজনিত কারণে ব্রিটেনজুড়ে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ বলেন, করোনায় ব্রিটেনে এথনিক মাইনোরিটি কমিউনিটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আছে বাংলাদেশিরা। আমরা স্বজন যেমন হারাচ্ছি, তেমনি অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে ক্রমেই বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
লন্ডনে শিক্ষকতা, সম্পাদনা ও সাংবাদিকতা পেশায় গত ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন ড. রেনু লুৎফা। তিনি বলেন, অভাব-অনটন, চাকুরীহীনতা মানুষের জীবনে নতুন কিছু নয়। বৃটেনের মানুষ বারবার এই সব প্রতিকুলতার সাথে লড়ে গেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর, বিভিন্ন মহামারীর পর লড়াকু মানুষ নতুন উদ্যমে জীবন গড়েছে। নতুন জীবিকা তৈরি করেছে। বাংলাদেশিদেরও নতুন জীবিকার অন্বেষণে বের হতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ক্যাটারিং ব্যবসার নতুন সংস্করণ করতে হবে। নতুন পেশার দিগন্ত খুঁজে বের করতে হবে।